‘নতুন সূর্য, নতুন প্রাণ, নতুন সুর, নতুন গান, নতুন ঊষা, নতুন আলো, নতুন বছর কাটুক ভালো, কাটুক বিষাদ, আসুক হর্ষ, শুভ হোক নববর্ষ’। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আবহমান কাল ধরে লালিত ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ‘বৈসাবি’। পার্বত্যাঞ্চলে জাতি ভেঁদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করা এ উৎসব। ‘ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের বৈসু, মারমা স¤প্রদায়ের সাংগ্রাই ও চাকমা স¤প্রদায়ের বিঝু এবং বাঙালির চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষ উৎসব’। মূলত বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু-নববর্ষ এর প্রথম চারটি অক্ষরে মিলিত রূপ “বৈসাবিন”। এ উৎসবকে ঘিরে বহুমুখী কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল শোভায় শোভিত হয় সমগ্র পার্বত্য জনপদ।
এ চৈত্রে ‘বৈসাবিন’ উৎসবের রঙে রূপের রাণী পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির পাহাড়জুড়ে এখন সবুজের প্লাবন। চৈত্র মাসে পুরোনো পাতা বির্সজন দিয়ে গাছেরা সেজেছে নতুন পত্রপল্লবে। জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে ‘বৈসাবি আর চৈত্রসংক্রান্তি’ ও নববর্ষ উৎসব’। বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণকে ঘিরে বহুমুখী কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল সব আয়োজন আর উৎসবকে ঘিরে এখন আনন্দে মাতোয়ারা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানুষ।
এবার খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে ৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে শুরু হয়, বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু-চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা’। তার পরেও পাহাড়জুড়ে তিনদিনব্যাপী মূল বৈসাবি উৎসবে রয়েছে ভিন্নতা।
‘বৈসু’, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব বৈসু বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথমদিন থেকে তিনদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনকে ‘হারিবৈসুক’, দ্বিতীয় দিনকে ‘বৈসুকমা’ বা বৈসুমা এবং তৃতীয় দিন ‘বিসিকাতাল’ নামে পরিচিত। এই দিন নববর্ষকে বরণ করা হয়। এ দিনকে বলা যায় খাদ্য উৎসব। এই দিনে পুরোনো শত্রæতা, দ্ব›দ্ব, বিবাদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের বাড়িতে হরেক রকমের পিঠাফুলি, ফলমূল মিষ্টান্নসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার আদানপ্রদার করা হয়। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো জনপ্রিয় খাবার ‘লাবড়া বা পাঁচন’। লাবড়া মানে হচ্ছে মিশ্রণ। প্রায় ২৫-৩০ ধরনের সবজির সংমিশ্রণে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার যা লাবড়া নামে পরিচিত।
‘বিসিকাতাল’ নববর্ষকে বরণের দিনে মূলত ত্রিপুরারা আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করা হয়। নদীর তীরে, মন্দিরে কিংবা বিশেষ পবিত্র স্থানে ফুল, ধুপ এবং দীপ জ¦ালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে। এছাড়া গৃহপালিত গবাদি পশুর পরিচর্যা এবং পশুদের গলায় ফুলের মালা পরানো হয়। এই দিনে পুরো ঘর বারি সাজানো হয়। এদিন আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ছোটরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের পা ধুয়ে প্রণাম করে। এতে পরিবার তথা আত্মীয়তার বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। এ দিনের বিশেষ আয়োজন থাকে ফুল ও পানি নিয়ে খেলার আয়োজন। বিশেষ করে পানি নিয়ে খেলাটা বৈসুর প্রধান আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য পানি দিয়ে পুরানো দিনের সকল গøানি ধুয়ে দেয়া। অবশ্য এই উৎসবের আগে জলপূজা করার রীতি আছে।
‘সাংগ্রাই’ মারমা সম্প্রদায়ের সকল অসুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ‘রি-আকাজা’ (জলকেলি) উৎসব পানি খেলা। পুরোনো বছরের গøানি ও কালিমা ধুয়েমুছে দূর করতে মারমা তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে একে অপরের প্রতি পানি ছিটিয়ে আনন্দ করে। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে আয়োজিত এ পানিখেলা খুবই আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য। পানি খেলার মাধ্যমে একে অপরের পছন্দের মানুষটিকেও খুঁজে নেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নতুন উন্মাদনা ও অনাবিল আনন্দের সুষ্টি হয়। মূলত উৎসবের দিন নির্দিষ্ট একটি জায়গায় নৌকা বা বিশাল কোনো পাত্র পানি আর ফুল দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তার দুই পাশে মারমা তরুণী ও যুবতীরা সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করেন। তরুণ ও যুবকরা সেই স্থানে পানিপূর্ণ পাত্র হাতে আসেন এবং অপেক্ষমাণ তরুণী ও যুবতীদের গায়ে পানি ছিটান। এতে পানিখেলার স্থানটি হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে দলবেঁেধ বেড়ায় আর রঙিন পারি ছিটিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ভিন্ন স্বাধের নানা রকমের ভালো খাবার তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করেন। নববর্ষেরদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ¯œান করে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী মারমা পোশাক পরিধার করে ভোর বেলায় সারিবদ্ধ হয়ে ‘সাংগ্রাইং প্রভাত ফেরি ও বৌদ্ধ বিহার/ক্যং এ ফুল পূজা দেয়। রাতে ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন এবং নতুন বছরের জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেন। এছাড়া খাগড়াছড়ি মারমা উন্নয়ন সংসদ’র আয়োজনে ও মারমা যুব কল্যাণ সংসদের সার্বিক সহযোগিতায় ঐতিহাসিক পানখাইয়াপাড়া বটতলায় ঐতিহ্যবাহী ‘রি-আকাজা’ (জলকেলি) উৎসব পানি খেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঐতিহ্যবাহী মারমা নৃত্য ও ওপেন কনসার্ট, দিনব্যাপী ‘আলারী’ খেলা এবং পুরুষদের ‘দঃ’ খেলার আয়োজ করা হয়েছে। এতে মারমা তরুণ-তরুণী ও যুবতীরা রঙবেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে।
‘বিঝু’ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়রা সংখ্যায় বেশি। ‘বিঝু’ তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভুতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিকাল থেকেই নাকি চাকমা সম্প্রদায় বিঝু পালন করে আসছে। চৈত্র মানের শেষ দিনকে চাকমারা বলে মূল বিঝু। এর আগের দিন ফুল বিঝু আর পয়লা বৈশাখ পরিচিত ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যেপোজ্যে দিন হিসেবে। এ দিন কেউ কোনো কাজকর্ম করে না, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে দিনটি পার করে। বিঝু মানে আনন্দ, হইহুল্লোড়, বিঝু মানে দল বেঁেধ ঘুরে বেড়ানো। বিঝু মানে মিলনমেলা সর্বোপরি ভ্রাতৃত্বের মেল-বন্ধন সৃষ্টি করা এবং সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা।
ফুল বিঝুর দিনে খুব ভোরে উঠে বন থেকে ফুল সংগ্রহ করা হয়। সারা বছরের সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে নব উদ্যমে নতুন বছর শুরু করার প্রত্যয়ে নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়াও হরেক রকম ফুল দিয়ে ঘর বাড়ি সাজানো হয়। এর পর শুরু হয় বিঝুর ধুম। বিঝুর আমেজ সুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এ দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপালিত পশুপাখিদের খাবার দেয়া হয়। নিজেদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধর দৃঢ় করতে এবং পুন্য সঞ্চার করতে গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের ¯œান করিয়ে দেয়া হয়।
মূল বিঝুর দিনে চাকমাদের প্রধান আকর্ষণ হলো পাজন বা পাঁচন। পাজন মূলত হরেক রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি করা তরকারি। ৩০-৩২ রকম সবজি দিয়ে এটি রান্না করা হয়। বিঝুর দিনে সাত ঘর ঘুরে পাজন খাওয়ার প্রথা আছে। প্রচলিত আছে সাত ঘর ঘুরে পাঁচন খেলে নাকি কোনো অসুখ আক্রমণ করতে পারে না। বিঝুর দিনে কেউ কাইকে নিমন্ত্রণ করতে হয় না। বিঝুতে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করা লক্ষে একে-অপরের বাড়িতে বেড়াতে হয়। মূলত বিঝু নাকি তাদেরকে সামাজিক হওয়ার প্রেরণা জোগায়। এদিন পাজনের পাশাপাশি চালের গুরার পিঠা আর পানীয়স্বরূপ ‘জগরা বা কাঞ্জি’ তৈরি করে পরিবেশন করা হয়।
এর পর গোজ্যেপোজ্যে, মানে পয়লা বৈশাখ। এদিন সবাই বৌদ্ধ বিহার (মন্দিরে) গিয়ে সমবেত প্রার্থনা করে সকল জীবের প্রতি মৈত্রী ও মঙ্গল কামনা করে। কেউ কেউ ধর্মীয় গুরুকে ডেকে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করেন। এদিনে নতুন চালের ভাত ও মাছ-মাংস দিয়ে ভোজন সারা হয়। বিশ^াস করা হয়, এই দিনে যদি ভোজন ভালো হয় তাহলে নাকি পুরো বছরের ভোজনে কোনো রকম কমতি হয় না। এই তিনদিন সন্ধা বেলায় ঘরের মূল খুঁটির সামনে, নদী এবং গৃহপালিত পশু-পাখিদের সামনে মোমবাতি প্রজ¦লন করা হয়। সবমিলিয়ে ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল রঙিন এ বৈসাবি উৎসবের আনন্দ, উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এখানে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর বহুমুখী কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল শোভায় শোভিত হয় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া জনপদ। মুছে যাক গøানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নি¯œানে শুচি হোক ধরা। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।