পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে সীমান্ত সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রাম দর্জিপাড়া। এই দর্জিপাড়া এখন পর্যটনপ্রেমিদের জন্য বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। দলে দলে মানুষ ছুটছে দর্জিপাড়ার দিকে। ওই এলাকার ২০ জন কৃষাণী দুই একর জমিতে চাষ করেছেন ১০ প্রজাতির টিউলিপ ফুল। নানান রঙের ফুলে ভরে গেছে গোটা জমি। আর শীতের অতিথি টিউলিপ ফুল দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন হাজারো পর্যটক। শুধু পঞ্চগড় নয়; বিভিন্ন জেলা থেকে ফুলপ্রেমিরা এখানে আসছেন টিউলিপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। গাইবান্ধা থেকে স্বপরিবারে তেঁতুলিয়া বেড়াতে এসেছেন কামিজ আয়শা দম্পত্তি। টিউলিপ বাগানের কথা শুনে চলে এসেছেন ফুল দেখতে। তিনি জানালেন, টিউলিপ বাগান দেখে মনটা ভরে গেল। ফুলের সৌন্দর্যে আমি অভিভ‚ত। শীতের দেশের এই ফুলটি তেঁতুলিয়ায় চাষ হবে তা কখনো ভাবতেও পারিনি। তেঁতুলিয়ায় আমাদের মত অনেক মানুষ বেড়াতে আসে। শীত মৌসূমে টিউলিপ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আশা করি আগামী বছর থেকে আরও ব্যাপক পরিসরে টিউলিপ চাষ হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই ফুল যাবে বিদেশে।
জানা গেছে, টিউলিপ ফুল চাষ হয় মূলত নেদারল্যান্ড, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ড, তুরস্কে। এছাড়া শীতপ্রধান অনেক দেশেই এখন বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে টিউলিপ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ফুল চাষ সহনশীল। পঞ্চগড়ে শীত মৌসূমে এই মাত্রার তাপমাত্রা থাকায় গত বছর নেদারল্যান্ড থেকে টিউলিপ ফুলের বাল্ব বা বীজ এনে তেঁতুলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ ফুলের চাষ শুরু করে উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-ইএসডিও। পরীক্ষামূলক চাষে সাফল্যের পর পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফ এবং ইণ্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভলপমেন্ট-ইফাদ’র সহযোগিতায় ইএসডিও এ বছর তেঁতুলিয়া উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দর্জিপাড়া গ্রামের ২০ জন কৃষাণীকে দিয়ে দুই একর জমিতে টিউলিপ ফুল চাষ করেছে। গত ১০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান ও পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার টিউলিপ ফুলের বাল্ব (বীজ) রোপণ উদ্বোধন করেন। ইএসডিও’র এই প্রকল্পের আওতায় চাষীরা এখানে ১০টি প্রজাতির ১০ কালারের টিউলিপ চাষ করেছেন। মাত্র ১৬ দিনের পরিচর্যায় ফুলের কলি আসে। ২০-২১ দিনের মধ্যেই ফুল ফুটতে শুরু করে। এই ফুলের বাল্ব বা বীজ রোপণের দিন হতে ১৮-২০ দিনের মধ্যে কলি আসে এবং ২৫-৬০ দিন পর্যন্ত এই ফুল স্থায়ী থাকে।বাল্বের পাশাপাশি ইএসডিও চাষীদেরকে প্রকল্প হতে বিনামুল্যে রাসায়নিক স্যার, জৈব সার, খৈল, শেডনেট এবং ফেন্সিংনেট (বেড়ার জাল) দেয়া হয়েছে। এছাড়া চাষীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফুল চাষাবাদে উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। উত্তরের শান্ত নিরিবিলি সবুজ শ্যামলিমা পর্যটন এলাকা পঞ্চগড় জেলায় টিউলিপ ফুলের বাগান সৃষ্টি হওয়ায় পর্যটনের আকর্ষণও বেড়েছে। দেশ বিদেশের নানা প্রাান্তের লোকজন নানান প্রজাতি ও নানা রঙের বাহারি টিউলিপ ফুল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। কেউ সেলফি তুলছেন। কেউ ফুল কিনছেন আবার কেউ ফুলসহ চারা কিনছেন।
শারিয়ালজোত গ্রামের কৃষাণী সাবিনা পারভীন জানান, আমরা ২০ জন কৃষাণী ইএসডিও’র সহযোগিতায় দুই একর জমিতে টিউলিপ ফুল চাষ করেছি। বীজ বপনের পর নিজেরাই বাগানের পরিচর্যা করছি। প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসছেন আমাদের বাগান দেখতে। বাগানের ঢোকার ফি, চারা ও ফুল বিক্রি করে ভাল আয় হচ্ছে। আমরা লাভবান হলে আগামী মৌসূমে আরও বেশি জমিতে টিউলিপ চাষ করব।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, সমতলের চা, কাঞ্চজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্যসহ প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের কারণে তেঁতুলিয়া ইতোমধ্যে পর্যটকদের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। পুরো শীত মৌসূমে লাখো পর্যটক আসেন তেঁতুলিয়া ঘুরতে। এরই মধ্যে শীতের ফুল টিউলিপ এগ্রি ইকো ট্যুরিজমে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এতে করে তেঁতুলিয়ায় পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে। কৃষি বিভাগ টিউলিপ চাষে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছে। আশা করছি আগামী মৌসূমে টিউলিপ চাষ আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।
ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার বলেন, তেঁতুলিয়ায় পর্যটকরা আসে চা বাগান দেখতে, আসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। গত বছর থেকে তারা আসছে টিউলিপ ফুল দেখতে। এবার আসছে, আসবে। আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে বিশ্বের নামকরা অন্য যে ফুলগুলো আছে সেগুলো তেঁতুলিয়ায় চাষ হবে। যা দেখতে পর্যটকরা সারাবছই আসবে। তেঁতুলিয়াসহ এই অঞ্চলকে সারা বছর বাংলাদেশের দরবারে ভাল কিছু দেখাতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। টিউলিপ চাষ প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক আয়ের নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। #