সোনালী সকাল রোদেলা দুপুর পড়ন্ত বিকেল গোধূলি শেষে সন্ধ্যা হলে বেশকিছু বাতি ও সোলার লাইট এর আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর তীর। কাঠের তৈরী নৌকায় জলে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ছোট্ট একটা নৌকাই যাদের ঘর-বাড়ি-সংসার। নৌকাতে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য আর সেই নৌকাতেই মৃত্যু।
সারাদিন রোদে পুরে অথবা বর্ষায় কাক ভেজা হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বিভিন্ন নদীর কিনারে। দিনভরের রোজগার দিয়ে সন্ধ্যায় চুলা জালায় নৌকার ছাউনিতেই। রাতেই হয় ভোজন। এভাবেই বসবাস করে আসছেন ওই নদীর কিনারে থাকা মান্তা পরিবার। আধুনিক সভ্যতা থেকে ছিটকে পরা এই দরিদ্র জনগোষ্ঠিরা তারা নিজেদের মান্তা জনগোষ্ঠি বলে দাবী করেন । বাংলাদেশের নাগরিক হলেও অন্যদের মতো সাধারন মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম এই জনগোষ্ঠি।
দেশের বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ এই পরিবারগুলো এখন তেঁতুলিয়া নদীসহ আশ-পাশের বিস্তীর্ন নদীতে তারা নৌকায় বসতি গড়ে তুলেছে। বাকেরগঞ্জ- বাউফল- দশমিনা -গলাচিপা উপজেলার বিভিন্ন নদীর কুল ঘেষা, লোহালিয়া, তেতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ এবং ডাকুয়া, নদীর তীরে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠির বসবাস।
বিশাল এই জনগোষ্ঠির প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা, নাই স্বাস্থ্য সেবা অথবা পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নিয়ম-কানুন জানা। বেশির ভাগই রোগ-বালাই সারতে যান কবিরাজ, বৈদ্যের কাছে। একটু বয়স হলেই সন্তানেরাও মাছ ধরায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগেরই। দেশের প্রধানত উপকূলবর্তী জেলা-উপজেলাগুলোর নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। প্রতিটি নৌকাতে একটি করে পরিবার, সে পরিবারের সমস্ত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশে আছে ঐ ছোট্ট নৌকাটিতে।
মান্তা জনগোষ্ঠি পরিবারের সদস্য শাহিন হাওলাদার বলেন, মুন্সিগঞ্জ জেলার বাসিন্ধা ছিলেন তারা। নদী ভাংঙ্গনে নিঃস্ব হয়ে তারা প্রথমে বাউফল উপজেলার তেতুলিয়া তার পরে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর কিনারে ঘাটি বাঁধে, তারপর থেকেই তারা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এই নদীর কিনারে বসবাস করে যাচ্ছেন, দিনরাত মাছ ধরে বাজারে বেচে তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতে হয়।
এভাবেই বিভিন্ন নদীর কিনারে শত শত নৌকায় নারী-পুরুষ, শিশুসহ শতশত মানুষের বসবাস। শিক্ষা, চিকিৎসা,খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মান্তা স¤প্রদায়। মান্তা স¤প্রদায় জনগোষ্ঠিতে শিক্ষার হার নেই বললেই চলে। এর বড় কারন হচ্ছে নদীতে ভাসমান জীবন কাটানোর ফলে এ স¤প্রদায়ের পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনা। এছাড়াও অভাব-দারিদ্রতা তাদের শিক্ষা বিমুখ করে রেখেছে। তবে বর্তমানে নতুন প্রজন্মের অনেকে শিশু পড়াশুনার চেষ্টা করছে। অসুখ-বিসুখে মান্তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগে মান্তারা সবচেয়ে বেশি ভোগে। নদী দূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ছে এই স¤প্রদায়ের মানুষের উপর।